ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

পেকুয়া-চকরিয়ায় ডব্লিউএফপির ত্রাণ বিতরণে নজিরবিহীন অনিয়ম-দূর্নীতি

মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া ::
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি’র) ত্রাণ বিতরণ ও তালিকা তৈরীতে নজিরবিহীন অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ত্রাণ বিতরণ ও উপকারভোগীদের তালিকা যাচাই-বাচাইয়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিতর্কিত এনজিও এসএআরপিভির বিরুদ্ধেও উঠেছে নানান গুরুতর অভিযোগ।

চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলায় বিশ্ব খাদ্য সংস্থার ত্রাণ বিতরণে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গণহারে ত্রাণের তালিকায় অর্ন্তভূক্তি করে ত্রাণ বিতরণ করায় সাধারন দরিদ্র ও অসহায় পরিবারগুলো বাদ পড়েছে। এনিয়ে চকরিয়া-পেকুয়ায় সাধারন দরিদ্র লোকজনের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এদিকে ডব্লিউএফপির ত্রাণের তালিকা বাতিল করার দাবিও জানিয়েছেন চকরিয়ার মুক্তিযোদ্ধা হাজী বশিরুল আলম।

খোঁজ জানা গেছে, ত্রাণের তালিকায় চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে অধিকতর স্বচ্ছল, ধনী, সরকারী কর্মচারী, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এমন লোকদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করায় ত্রাণের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সচেতন মহল।

করোনার কারণে সারা বাংলাদেশে কর্মহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার লোক। তাই এসব কর্মহীন হয়ে যাওয়া লোকজনের মাঝে খাদ্য সামগ্রী তুলে দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, এনজিও সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্যকারী সংস্থা এগিয়ে আসেন।

এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি) ও এগিয়ে আসেন। চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় ত্রাণ বিতরণের জন্য বিশ^ খাদ্য সংস্থা বিতর্কিত এনজিও এসএআরপিভিকে দায়িত্ব দেন। চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার স্ব-স্ব ইউনিয়নের চেয়ারম্যানেরা তালিকা প্রস্তুত করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুমোদন নিয়ে এনজিও এসএআরপিভিকে জমা দেন।

কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত এনজিও এসএআরপিভি মাঠ পর্যায়ে এসব তালিকা যাচাই করেনি। চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা বিশ^ খাদ্য সংস্থা নগদ অর্থ সহ চারমাস খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করবে। এ চারমাসে ত্রাণ বিতরণের সহায়তা ও আনুষ্টানিক কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য এনজিও এসএআরপিভি গোপনে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে লোক নিয়োগ করেছে। লোক নিয়োগের জন্য অনলাইনে বা কোন পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও দেয়নি এনজিওটি। এর আগেও বিশ^ খাদ্য সংস্থার অর্থায়নে পেকুয়ায় পুষ্টি প্রকল্পে জনবল নিয়োগেও ব্যাপক অনিয়ম-দূর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিল এনজিও এসএআরপিভি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পেকুয়া উপজেলায় ত্রাণের তালিকায় নাম এসেছে শতকরা ৯০ ভাগ রাজনীতিবীদ ও স্বচ্ছল লোকের। মাত্র ১০ ভাগ পেয়েছে গরীব ও কর্মহারা লোকজন। পেকুয়া উপজেলার মগনামায় সরকারী কর্মচারী, এমপিওভূক্ত শিক্ষক, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, ইউপি সদস্য, বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পরিবারের একাধিক সদস্যের নাম ত্রাণের তালিকায় রয়েছে এবং তারা বিশ^খাদ্য সংস্থার ত্রাণও পেয়েছে।

এছাড়াও পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া, পেকুয়া সদর, বারবাকিয়া, শিলখালী, টইটং ও রাজাখালী ইউনিয়নেও ত্রাণের তালিকা তৈরীতে মগনামা ইউনিয়নের ন্যায় ব্যাপক অনিয়ম-দূর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত এনজিও মাঠ পর্যায়ে তালিকা যাচাই-বাচাই না করে ত্রাণ বিতরণ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
অপরদিকে, চকরিয়া উপজেলার প্রত্যেকটি ইউনিয়নেও তালিকা তৈরীতে পেকুয়ার ন্যায় চরম অনিয়ম ও দূর্নীতি হয়েছে বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন। চকরিয়া লক্ষ্যাচর, ডুলাহাজারা, বরইতলী ও হারবাং, কাকারা ইউনিয়নেও তালিকা তদন্ত করলে তলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
এ প্রসংগে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী বশির বলেন, ভেওলা মানিকচর ইউনিয়নে যা তালিকা হয়েছে ওই তালিকা করতে চেয়ারম্যানের মতামত নেয়া হয়নি। শুধু তালিকায় স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। এভাবে প্রায় অধিকাংশ ইউনিয়নে চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে শুধুমাত্র স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে, চকরিয়ার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বার সাইফুল ও এ ব্যাপারে মোটেই অবগত নয়। ব্যাপক অভিযোগ ধামা-চাপা দিতে প্রায় সংবাদকর্মীদের নামও ত্রাণের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় ত্রাণ বিতরণের সময়ে প্রতিটি ওয়ার্ড়ে একজন চৌকিদার ও দুই জন শ্রমিকের জন্য মোট ১৮ শত টাকা করে বেতন দেয়ার নিয়ম থাকলে দেয়া হয়েছে জনপ্রতি ৯ শত টাকা করে। প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে অর্ধেক টাকা চকরিয়া ও পেকুয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত এনজিও এসএআরপিভির ডিস্টিভিউটারগণ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

পেকুয়া ও চকরিয়া ত্রাণের তালিকা তৈরীতে অনিয়ম ও ত্রাণ বিতরণের বিষয়ে জানতে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিতর্কিত এনজিও এসএআরপিভি কক্সবাজার অফিসের পরিচালক কাজী মাসুদুল আলম মুহিত এর কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ তালিকা করেছে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা। আমার অফিসের দায়িত্বরত কেউ করেনি। শুধু বিতরণ করার দায়িত্বে ছিলেন। তবে তিনি স্বীকার করে বলেন এসব প্রশ্ন না করার জন্যতো সব কলম সৈনিকদের এ তালিকায় আওতাভূক্ত করে খাদ্য সামগ্রী দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় অনিয়মের মাধ্যমে করা তালিকার উপকারভোগীদের মাঝে তিন কিস্তিতে ৪ হাজার ৫ শত নগদ টাকা ও ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। এ কর্মসূচীর আওতায় চকরিয়া উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ১৮ ইউনিয়নের ১৬ হাজার ৫শত পরিবার। পেকুয়া উপজেলা ৭ ইউনিয়নের ৫ হাজার ৫ শত জনকে অর্ন্তভূক্তি করা হয়েছে। চার মাসে চার কিস্তিতে চকরিয়ার ১৬ হাজার ৫শত পরিবারের প্রতি পরিবার পাবেন ৬০ কেজি চাল, ৫ কেজি হাই এনার্জি বিস্কুট ও নগদ ৪ হাজার ৫শত করে টাকা। পেকুয়ায় ৫ হাজার ৫শত পরিবারের প্রতি পরিবার পাবেন ৬০ কেজি ভাল মানের চাল ও নগদ ৪ হাজার ৫শত করে টাকা।

সচেতন মহল অভিযোগ করেছেন, বিশ^খাদ্য সংস্থার উদ্যোগ মহৎ হলেও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় চকরিয়া ও পেকুয়ায় ত্রাণ বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিতর্কিত এনজিও এসএআরপিভির অনিয়ম ও দূর্নীতির কারণে এ ধরনের মহৎ উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্য হয়ে পড়েছ।

পাঠকের মতামত: